আই লাভ ইউ অল

গল্পঃ
আই লাভ ইউ অল

By Adivai_Admin April 16, 2024 No Comments 1 Min Read

ভারতের একটা শহরের পঞ্চম শ্রেণী প্রাথমিক স্কুলের এক শিক্ষিকা,যাঁর অভ্যাস ছিল, ক্লাস শুরু হওয়ার আগে রোজ তিনি “আই লাভ ইউ অল” বলতেন। কিন্তু তিনি জানতেন, তিনি সত্য বলছেন না। তিনি জানতেন ক্লাসের সবাই কে এক রকম ভাবে তিনি ভালবাসেন না।

রাজু নামে একটা বাচ্চা ক্লাসে যাকে তিনি মোটেও সহ্য করতে পারতেন না। রাজু ময়লা জামা-কাপড় পড়ে স্কুলে আসতো। তার চুলগুলো থাকত উষ্কো-খুষ্কো, খোলা থাকে জুতার বকলেস,শার্টের কলারে ময়লা দাগ, ক্লাসে পড়া বোঝানোর সময়ও সে থাকে খুব অন্য মনস্ক। মিস এর বকুনি খেয়ে, চমকে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকতো সে। কিন্তু তার শূন্য দৃষ্টি দেখে স্পষ্ট বোঝা যেত যে, রাজু শারীরিক ভাবে ক্লাসে উপস্থিত থাকলেও তার মন অন্য কোনখানে উধাও হয়ে গেছে, রাজুর প্রতি ধীরে ধীরে মিসের মনে ঘৃণার উদ্রেক হলো।

রাজু ক্লাসে ঢুকতেই, মিসের সমালোচনার শিকার হতো। সব রকম খারাপ কাজের উদাহরন রাজুর নামে হতে থাকল। বাচ্চারা তাকে দেখে আর খিলখিল করে হাসে, মিসও তাকে অপমান করে আনন্দ পান। রাজু যদিও এইসব কথার কোনও উত্তর দিতো না। মিস এর তাকে নিষ্প্রাণ পাথর বলে মনে হতো, যার মধ্যে অনুভূতি নামে কোন জিনিস ছিলো না। সমস্ত ধমক, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ আর শাস্তির জবাবে সে শুধু নিজের ভাবনায় শূন্য দৃষ্টিতে তাঁকে দেখতো, আর মাথা নীচু করে নিতো। এই ভাবে সে মিস এর অত্যন্ত বিরাগ ভাজন হয়ে উঠলো।

প্রথম সেমিস্টার শেষ হয়ে রিপোর্ট বেরোনোর সময় হলে মিস রেজাল্ট কার্ডে তার সম্পর্কে সব খারাপ কথা লিখে দিলেন l মা -বাবাকে দেখানোর আগে রিপোর্ট কার্ড হেড মিস্ট্রেসের কাছে পাঠাতে হতো। তিনি রাজুর রিপোর্ট দেখে মিসকে ডেকে পাঠালেন এবং বললেন, “মিস ! রিপোর্ট কার্ডে কিছু তো অনুপ্রেরণার কথা লেখা উচিত্ ! আপনি তো যা কিছু লিখেছেন তার থেকে রাজুর বাবা একদম নিরাশ হয়ে যাবেন।” মিস বললেন, “আমি মাফ চাইছি, কিন্তু রাজু এক খারাপ আর নিষ্কর্মা বাচ্চা, আমার মনে হয়না আমি ওর সম্পর্কে ভাল কিছু লিখতে পারবো !” মিস ঘৃণার সাথে এই কথা বলে সেখান থেকে উঠে এলেন।

হেড মিস্ট্রেস অদ্ভুত একটা ব্যাপার করলেন, তিনি চাপ রাশির হাত দিয়ে মিসের ডেস্কের ওপরে রাজুর আগের বছরের রিপোর্ট কার্ড রেখে দিলেন। পরের দিন যখন মিস ক্লাসে ঢুকলেন তখন রিপোর্টের ওপরে নজর পড়তে, উল্টে দেখেন সেটা রাজুরই রিপোর্ট কার্ড ! ভাবলেন আগের বছরও নিশ্চয়ই সে এইরকম আচরণ করেছে ! ভাবার সাথে সাথেই তৃতীয় শ্রেণীর রিপোর্টটা খোলেন, রিপোর্টের মন্তব্য পড়ে ওনার আশ্চর্যের সীমা রইলো না, রাজুর উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় রিপোর্ট কার্ডটি ভরা, তাতে লেখা আছে, “রাজুর মতো বুদ্ধিমান বাচ্চা আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি। অতি সংবেদনশীল বাচ্চা এবং নিজের সহপাঠী আর শিক্ষকের প্রতি সম্মান এবং সহযোগিতা করে। অন্তিম সেমিস্টারেও রাজু প্রথম স্থান আধিকার করে নেয়। অস্থির ভাবে মিস চতুর্থ শ্রেণীর রিপোর্ট খোলেন, সেখানে লেখা আছে “রাজুর লেখা পড়ার ওপর তার মায়ের অসুখের গভীর প্রভাব পড়ছে, পড়াশোনার প্রতি অমনোযোগী হয়ে উঠছে। রাজুর মা মারা গেছে এবং সঙ্গে রাজুর জীবনের যাবতীয় আশা ভরসা আর সুন্দর ভবিষ্যতের আলোও, তাকে বাঁচাতে হবে। আরও দেরী হয়ে যাওয়ার আগে, মিস এর মাথায় যেন অত্যন্ত ভারী বোঝা চেপে আছে, কাঁপা হাতে তিনি রিপোর্ট কার্ড বন্ধ করেন। তার নয়ন অশ্রুসজল হয়ে উঠলো, টপ টপ করে চোখের জল ঝরতে লাগলো।

পরের দিন যখন ক্লাসে ঢুকলেন তাঁর নিজের চির অভ্যস্ত বাক্যের পুনরাবৃত্তি করলেন, “আই লাভ ইউ অল” কিন্তু বুঝতে পারছিলেন আজও তিনি সত্যের অপলাপ করছেন। কারণ এলোমেলো চুলে এই ক্লাসে বসে থাকা বাচ্চাটা, রাজুর প্রতি যে স্নেহ তিনি হৃদয়ে অনুভব করছিলেন, তা’ ক্লাসের অন্য বাচ্চাদের জন্য হওয়া সম্ভবই ছিল না। পড়া বোঝানোর সময় রোজের দিনচর্চার মতো রাজুর দিকে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, আর রাজুও রোজের মতো মাথা নীচু করে নিলো। যখন বেশ কিছুক্ষণ পর্যন্ত মিস এর ধমক বা শ্লেষাত্মক কথার কোনটাই বা সহপাঠীদের সম্মিলিত হাসির শব্দ কানে এলো না তখন সে আচমকা মাথা উঁচু করে তাঁর দিকে চেয়ে রইলো। অপ্রত্যাশিতভাবে তার মাথা আজ মুন্ডিত, কেশহীন ছিলো। তাঁর মুখে মৃদু হাসি। তিনি রাজুকে কাছে ডাকলেন এবং প্রশ্নের উত্তর বলে দিয়ে তা’ আওড়াতে বললেন। রাজু তিন-চারবার চেষ্টার পর অবশেষে বলতে পারলো। তার জবাব দেওয়ার সাথে সাথে মিস খুশি হয়ে শুধু নিজে তালি দিলেন না, বরং অন্য সব বাচ্চাদের দিয়েও তালি দেওয়ালেন। তারপরে এটা প্রত্যেক দিনের দিনচর্চা হয়ে গেলো। মিস সব উত্তর নিজের থেকে দিতেন, তারপর সস্নেহে রাজুকে বাহবা দিতেন। সব ভালো কাজের উদাহরণে রাজুর নাম বলা হতে লাগলো। ধীরে ধীরে বিষণ্ণতার কবর ফুঁড়ে রাজু বেরিয়ে আসলো। এখন থেকে আর মিস কে প্রশ্নের সাথে উত্তর বলে দেওয়ার প্রয়োজন হতো না। সে রোজ সঠিক উত্তর দিয়ে সবাই কে প্রভাবিত করতো এবং নতুন নতুন প্রশ্ন করেও হয়রানও করতো।তার চুলগুলো এখন অনেকটা পরিপাটি থাকে, জামাকাপড়ও যথেষ্ট পরিষ্কার থাকে, হয়তো সে নিজেই কাচঁতে শুরু করে ছিল। দেখতে দেখতে বছর শেষ হয়ে গেল, রাজু দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে পরবর্তী ক্লাসে উত্তীর্ণ হলো।

বিদায় কালীন সমারোহে সব বাচ্চারা মিস এর জন্য সুন্দর সুন্দর উপহার নিয়ে এলো, আর মিস এর টেবিলের ওপর একের পর এক পাহাড় জমে গেলো। এত সুন্দর ভাবে প্যাক করা উপহারের মধ্যে পুরানো কাগজে অগোছালো ভাবে মোড়া একটা উপহার পড়ে ছিলো। বাচ্চারা তাই দেখে হাসতে লাগলো। কারও জানতে বাকি রইলো না যে, উপহার হিসেবে সেটা রাজুই এনেছে। মিস উপহারের এই ছোট পাহাড় থেকে সেটা বার করে আনলেন, খুলে দেখলেন তার ভিতরে মহিলাদের আতরের অর্ধেক ব্যবহার করা একটা শিশি আর এক হাতে পরার মতো বড় একটা বালা যার বেশির ভাগ মোতি ঝরে গিয়ে ছিলো। মিস চুপচাপ শিশি থেকে নিজের গায়ে আতর ছিটিয়ে দিলেন এবং বালাটা হাতে পরে নিলেন। বাচ্চারা এই দৃশ্য দেখে খুব অবাক হয়ে যায়। রাজু নিজেও, শেষ পর্যন্ত রাজু থাকতে না পেরে মিসের কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ পর সে থমকে থমকে মিসকে বলল, “আজ আপনার গা’ থেকে আমার মায়ের মতো গন্ধ আসছে।

সময় পাখা মেলে উড়তে লাগলো। দিন সপ্তাহে, সপ্তাহ মাসে আর মাস বছরে বদলাতে আর কোথায় সময় লাগে ? কিন্তু প্রত্যেক বছরের শেষে রাজুর কাছ থেকে একটা চিঠি নিয়মিত ভাবে আসতো, যাতে লেখা থাকে, “এই বছর অনেক নতুন টিচারের সংস্পর্শে এসেছি কিন্তু আপনার মতো কেউ ছিলো না। তারপর রাজুর স্কুল পর্ব শেষ হয়ে গেলো এবং চিঠির ধরাবাহিকতা হলো শেষ।

কয়েক বছর পর মিস এরও অবসর হয়ে গেল। একদিন তাঁর নিজের মেলে রাজুর চিঠি পেলেন যাতে লেখা ছিলো, “এই মাসের শেষে আমার বিয়ে, আপনাকে ছাড়া বিয়ের কথা ভাবতে পারি না, আরেকটা কথা, জীবনে আমি অনেক লোকের সাথে মিশেছি, আপনার মতো কেউ নেই, ডক্টর রাজু, সাথে প্লেনে যাওয়া আসার টিকিটও খামের মধ্যে দিয়েছিলো।

মিস নিজেকে কিছুতেই আটকে রাখতে পারছিলেন না। তিনি স্বামীর থেকে অনুমতি নিয়ে অন্য শহরে যাওয়ার জন্য রওনা দিলেন। বিয়ের দিনে যখন বিয়ের আসরে উপস্থিত হলেন, তখন খানিকটা দেরী হয়ে গিয়েছিলো। তাঁর মনে হয়েছিল বিয়ের অনুষ্ঠান নিশ্চয়ই শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু এটা দেখে তাঁর আশ্চর্য হওয়ার সীমা ছিলো না, শহরের বড় বড় ডাক্তার, বিজনেসম্যান, এমন কি বিয়ে দেবেন যিনি সেই পণ্ডিতজীও ক্লান্ত হয়ে পড়ে ছিলেন, যে এখনও কার আসা বাকি আছে, কিন্তু রাজু বিয়ের অনুষ্ঠানের মণ্ডপের বদলে গেটের দিকে চোখ লাগিয়ে তাঁর আসার অপেক্ষা করছিলো। তারপর সবাই দেখে ছোটবেলার সেই টিচার গেটের ভিতরে ঢুকতেই রাজু তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হাত ধরেছে, যে হাতে তিনি এখনও সেই খারাপ হয়ে যাওয়া বালাটা পরে ছিলেন, তাঁকে সসম্মানে মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হলো। মাইক হাতে নিয়ে সে এইরকম কিছু বললো, “বন্ধুরা ! আপনারা সবাই সব সময় আমাকে আমার মায়ের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেন? আর আমি আপনাদের সবার কাছে প্রতিজ্ঞা করতাম যে, খুব শিগগির সবাই কে তাঁর সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো, ইনি আমার মা “

“আই লাভ ইউ অল” এর মতো আরও গল্প পড়তেঃ ভিজিট করুন

ঘর সাজাতেঃ Canvaswala || ব্যবসা বাড়াতেঃ Fixcave

Leave a Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *